Tutorialsপ্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য

চণ্ডীমঙ্গল কাব্য বণিক খণ্ডের কাহিনি

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের দুটি কাহিনি – আখেটিক খণ্ড ও বণিক খণ্ড। প্রথম খণ্ডের কাহিনি আমরা আগেই উপস্থাপন করেছি। আজকের আলোচনায় পাচ্ছেন কাব্যের বণিক খণ্ডের কাহিনি। আমরা অতি নিখুঁতভাবে কাহিনিটি উপস্থাপন করেছি। বাংলা সাহিত্যের আগ্রহী পাঠক পাঠিকা রসতৃষ্ণা মেটাবে এই চণ্ডীমঙ্গল কাব্য বণিক খণ্ডের কাহিনি আলোচনাটি। কাব্যের ধনপতি উপাখ্যান বা বণিক খণ্ডের কাহিনি নিম্নরূপ।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্য বণিক খণ্ডের কাহিনি

ধনপতি সদাগর উজানি নগরের বণিক। তিনি একদিন তার বন্ধুস্থানীয় জনার্দন ওঝার সঙ্গে পায়রা ওড়াচ্ছিলেন। ধনপতির সেই পায়রা কিছুদূরে ক্রীড়ারতা খুল্লনার আশ্রয় নিল। পায়রার অনুসন্ধানে ধনপতি সেখানে এলেন এবং তার পায়রা চাইলেন, খুল্লনা তা ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করল এবং ধনপতির সঙ্গে কৌতুক করে পায়রা নিয়ে চলে গেল।

খুল্লনার রূপে মুগ্ধ হয়ে ধনপতি জনার্দন ওঝাকে খুল্লনার সঙ্গে তাঁর বিবাহ প্রস্তাব পাঠালেন। বিবাহের সম্মতিও পাওয়া গেল। কিন্তু ধনপতির প্রথমা স্ত্রী লহনা এই বিবাহের কথা শুনে অভিমান করল। ধনপতি তাকে অনেক আশ্বাস দিলেন, শেষে লহনা একখানি পাটশাড়ি ও চুড়ি গড়াবার জন্য পাঁচ তোলা সোনা পেয়ে বিবাহে সম্মতি দিল।

বিবাহের পর ধনপতিকে রাজাজ্ঞায় গৌড়ে যেতে হল। গৌড়ে যাবার সময় ধনপতি খুল্লনাকে লহনার হাতে সমর্পণ করে গেলেন। লহনাও স্বামীর কথামতো খুল্লনাকে স্নেহের চোখে দেখতে লাগল।

এদিকে লহনা ও খুল্লনা দুই সতীনের মধ্যে এরূপ পরস্পর প্রীতির ভাব দেখে দুর্বলা দাসীর হিংসে হল। সে লহনাকে খুল্লনার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে অনেক কূট পরামর্শ দিল। সে সফলও হল। খুল্লনাকে স্বামীর চোখে বিষ করতে লহনা নানা রকম মন্ত্রপূত ঔষধের ব্যবস্থা করল। কিন্তু তাতে যখন কোনো কাজ হল না, তখন লহনা তার স্বামীর নামাঙ্কিত এক জাল পত্র নিয়ে খুল্লনার কাছে গেল।

অতঃপর

সেই পত্রে নির্দেশ ছিল আজ থেকে খুল্লনাকে ছাগল চরাতে হবে, ঢেঁকিশালে শুতে হবে, এক বেলা আধ পেটা খেতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু বুদ্ধিমতী খুল্লনা বুঝল, পত্রটি তার স্বামীর লেখা নয়। সে প্রথমেই ঐ সমস্ত কাজ করতে অস্বীকার করল। তর্কবিতর্ক হল এবং শেষাবধি কলহ। বিবাদে লহনার জয় হল। খুল্লনাকে বাধ্য হইয়া ছাগল চরাতে যেতে হল, ঢেঁকিশালে শয়ন করতে হল।

এরপর খুল্লনা বনে আশ্রয় গ্রহণ করল। এই বনেই সে পঞ্চ দেবকন্যার দেখা পায়। তারা খুল্লনাকে চণ্ডীপূজা শিক্ষা দিল। খুল্লনা চণ্ডীর পূজা করল। চণ্ডী খুল্লনাকে দেখা দিলেন। দেবী তাকে স্বামীপত্র লাভের বর দিলেন।

এদিকে দেবী চণ্ডী লহনাকেও স্বপ্নাদেশ দিলেন। খুল্লনার প্রতি পূর্বের ন্যায় আদর যত্ন করতে আদেশ দিলেন। স্বপ্ন দেখিয়া লহনার নিদ্রা ভঙ্গ হলে তার মনে অনুতাপ হল। সকালে যখন খুল্লনা গৃহে ফিরে এল, তখন চণ্ডীর স্বপ্নাদেশের কথা স্মরণ করে সে আগের মতো তাকে আদর যত্ন করতে লাগল।

এদিকে ধনপতি গৌড়ে থাকাকালীন বাড়ির কথা ভুলে ছিলেন। চণ্ডী সেই রাত্রে ধনপতিকে স্বপ্ন দিলেন যে, খুল্লনার প্রতি লহনা দুর্ব্যবহার করছে। ধনপতির বাড়ির কথা মনে পড়ল। তিনি বাড়ি ফিরলেন।

সেদিন বাড়িতে বহু মানুষ নিমন্ত্রিত। ধনপতি খুল্লনাকে রান্না করতে বললেন। লহনা আপত্তি করল এবং রন্ধনকার্যে খুল্লনার নৈপুণ্যের অভাবের কথা তুলে তাকে রান্নার কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু লহনার এই আপত্তিতে কোনো ফল হল না, খুল্লনাই রাঁধতে গেল। চণ্ডী খুল্লনাকে বর দিলেন। ফলে রান্না খুব ভালো হল। সকলেই প্রশংসা করলেন।

ধনপতির সিংহল যাত্রা

কিছুদিন পরে ধনপতিকে সিংহল যাত্রা করতে হল। খুল্লনা তখন গর্ভবতী। যাত্রার নির্ধারিত সময় অশুভ ছিল; কিন্তু ধনপতি ভ্রুক্ষেপ না করে সাতটি ডিঙা বোঝাই করে যাত্রার আয়োজন করলেন। খুল্লনা পতির মঙ্গল কামনা করে চণ্ডীপূজা করতে বসল।

ধনপতি ছিলেন পরম শৈব; স্বামীর চোখে খুল্লনাকে বিষ প্রতিপন্ন করবার জন্য লহনা ধনপতিকে খুল্লনার চণ্ডীপূজার কথা জানাল। ধনপতি ক্রোধে চণ্ডীর ঘটে লাথি মেরে চলে গেলেন।

অকূল সমুদ্রে ধনপতিকে উচিত শিক্ষা দিতে দেবী চণ্ডী তাঁর ছয় ডিঙা ডুবিয়ে দিলেন। একমাত্র মধুকর ডিঙা নিয়ে পথে অনেক কষ্ট সহ্য করে সিংহলে পৌঁছালেন। সিংহলের পথে চণ্ডী তাঁকে ‘কমলে-কামিনী’র মূর্তি’ দেখালেন। সিংহলরাজ ধনপতির পরিচয় পেয়ে তাঁকে যথেষ্ট আদর যত্ন করলেন। কিন্তু ধনপতির মুখে ‘কমলে-কামিনী’র বৃত্তান্ত শুনে বিশ্বাস করলেন না। শেষাবধি সিংহলরাজ তাঁকে বললেন যে, ‘কমলে-কামিনী’ দেখাতে পারলে তাঁকে অর্ধেক রাজত্ব দেবেন, না পারলে ধনপতিকে যাবজ্জীবন কারারুদ্ধ থাকতে হবে। ধনপতি স্বীকৃত হলেন, কিন্তু দেবী চণ্ডীর ছলনায় সিংহলরাজকে তিনি সে দৃশ্য দেখাতে পারলেন না। অঙ্গীকার-অনুযায়ী ধনপতিকে কারাগৃহে অবরুদ্ধ থাকতে হল।

শ্রীমন্তর সিংহল যাত্রা

এদিকে খুল্লনার এক পুত্র হল – শ্রীমন্ত। সে ক্রমে বড় হল; পাঠশালায় পড়তে গেল। একদিন গুরু মহাশয়কে পরিহাস করায় গুরু রেগে গিয়ে তার জন্ম সম্বন্ধে কটাক্ষ করলেন। সেইদিনই তরুণ শ্রীমন্ত পিতার সন্ধানে সিংহল যাত্রা করতে মনস্থ করল। সে সাত ডিঙা সাজিয়ে সিংহল যাত্রা করল।

যাত্রাপথে শ্রীমন্তও জলরাশির মধ্যে সেই কমলে-কামিনী’র মূর্তি দেখে সিংহলরাজকে গিয়ে তা বলল। রাজা বললেন, ‘যদি তুমি তা আমাকে দেখাতে পার, তা হলে তোমাকে অর্ধেক রাজ্য ও তোমার সঙ্গে আমার কন্যার বিবাহ দেব, নচেৎ দক্ষিণ মশানে তোমার শিরশ্ছেদ করা হবে।’

শ্রীমন্তকেও চণ্ডী ছলনা করলেন। শ্রীমন্ত সিংহলরাজকে ‘কমলে-কামিনী’র মূর্তি দেখাতে পারল না। রাজার লোকেরা তাকে মশানে নিয়ে গেল। সেখানে শ্রীমন্ত দেবী চণ্ডীর স্তব করতে লাগল। চণ্ডী মশানে এসে উপস্থিত হলেন। রাজার সৈন্যগণ চণ্ডীর ভূতপ্রেতের হস্তে পরাজিত হল। চণ্ডী শ্রীমন্তকে কোলে নিলেন।

দেবী চণ্ডীর কৃপায় সিংহলরাজ ‘কমলে-কামিনী’র মূর্তি দেখতে পেলেন। ধনপতি ও শ্রীমন্তের মিলন হল। শ্রীমন্তের সঙ্গে সিংহল-রাজকন্যা সুশীলার বিবাহ হল। উজানি নগরে এসে শ্রীমন্ত সেখানকার রাজাকেও ‘কমলে-কামিনী’র মূর্তি দেখালো। উজানির রাজকন্যা জয়াবতীর সঙ্গে শ্রীমন্তর বিবাহ দেওয়া হল।

ভিডিও দেখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

TO GET LATEST UPDATES AND TUTORIALS FOR FREE..

X