Tutorialsব্যাকরণ

বাংলা ভাষার উপভাষা – বিস্তারিত আলোচনা

বিশ্বের প্রাচীন ও আধুনিক প্রায় সব ভাষারই রয়েছে নানা আঞ্চলিক বৈচিত্র্য। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা ঘটেনি। বাংলা ভাষার অন্তর্গত এমন বিশেষ বিশেষ রূপ প্রচলিত আছে যা এক একটি বিশেষ অঞ্চলে প্রচলিত। সেগুলিকে আমরা বাংলা ভাষার উপভাষা বলি। আমাদের এই আলোচনায় বাংলা ভাষার উপভাষাগুলি সম্পর্কে যথাসম্ভব বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হল।

বাংলা ভাষার উপভাষা – উপভাষা কী?

উপভাষা হল একটি মূল ভাষার আঞ্চলিক রূপ যার সঙ্গে আদর্শ ভাষা বা সাহিত্যিক ভাষার ধ্বনিগত, রূপগত ও বিশিষ্ট বাগধারাগত পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য এমন সুস্পষ্ট যে ঐসব বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের রূপগুলিকে স্বতন্ত্র বলে ধরা যাবে, অথচ পার্থক্যটা যেন এতো বেশি না হয় যাতে আঞ্চলিক রূপগুলিই এক একটি সম্পূর্ণ পৃথক ভাষা হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষার প্রধান পাঁচটি কথ্য উপভাষা রয়েছে। এই পাঁচটি কথ্য উপভাষার পরিচয় আলোচিত হল।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমরা এর আগে ব্যাকরণের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। ভবিষ্যতেও ব্যাকরণ অংশ থেকে আরও প্রয়োজনীয় তথ্য পরিবেশিত হবে। তাই অনুরোধ, সাইটটি নিয়মিত দেখুন। আমাদের ভিডিও টিউটোরিয়াল ও PDF পেতে আমাদের ইউটিউব চ্যানেল প্রয়াস সাবস্ক্রাইব করে রাখুন।

১. রাঢ়ী উপভাষা

বাংলা ভাষার পাঁচটি কথ্য উপভাষার মধ্যে রাঢ়ী উপভাষা অন্যতম। অবস্থান অনুসারে আমরা এই উপভাষাকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করে নিতে পারি। যেমন – (১) পূর্ব রাঢ়ী যার এলাকাগুলি হল কলকাতা, চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, হাওড়া, হুগলি, মুর্শিদাবাদ। (২) পশ্চিম রাঢ়ী যার এলাকাগুলি হল বীরভূম, বর্ধমান, পূর্ব বাঁকুড়া। এবার আমরা রাঢ়ী উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি দেখে নেব।

ক. ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১) এই উপভাষায় ‘অ’ এর উচ্চারণ অনেক সময় ‘ও’ হয়। যেমন – অতি > ওতি, সত্য > শোত্তো, মধু > মোধু ।
২) এই উপভাষার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য স্বরসংগতি। এর ফলে শব্দের মধ্যে পাশাপাশি অবস্থিত বিষম স্বরধ্বনি সম স্বরধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন – দেশি > দিশি ।
৩) ‘ল’ কোথাও কোথাও ‘ন’ রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন – লুচি > নুচি , লোহা > নোয়া ।
৪) শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাত থাকার কারণে শব্দের অন্তে অবস্থিত মহাপ্রাণ ধ্বনি অল্পপ্রাণ ধ্বনি রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন – দুধ > দুদ, মাছ > মাচ।
৫) শব্দের মাঝে নাসিক্য ব্যঞ্জন যেখানে লোপ পেয়েছে সেখানে পূর্ববর্তী স্বরের নাসিক্যভবন ঘটে। যেমন – বন্ধ > বাঁধ, চন্দ্র > চাঁদ।

খ. রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১) অধিকরণ কারক ‘এ’ এবং ‘তে’ বিভক্তির প্রয়োগ এই উপভাষার লক্ষণীয় একটি বৈশিষ্ট্য। যেমন – ঘরেতে বাবা নেই।
২) কর্তৃকারক ছাড়া অন্য কারকে বহুবচনে ‘দের’ বিভক্তি যোগ হয়। যেমন – আমাদের বই দাও (কর্মকারক)।
৩) সদ্য অতীতে প্রথম পুরুষের অকর্মক ক্রিয়ার বিভক্তি হল ‘ল’। যেমন – সে গেল।
৪) মূল ধাতুর সঙ্গে ‘আছ্’ ধাতু যোগ করে সেই আছ্ ধাতুর সঙ্গে কাল ও পুরুষের বিভক্তি যোগ করে ঘটমান বর্তমান ও ঘটমান অতীতের রূপ গঠন করা হয়। যেমন – কর + ছি = করছি (আমি করছি , কর + ছিল = করছিল (সে করছিল) ।

২. বঙ্গালি উপভাষা

রাঢ়ীর পরেই বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য উপভাষা হল বঙ্গালি। এই উপভাষার এলাকাগুলি হল ঢাকা, মৈমনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশোহর, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি। আমরা বঙ্গালি উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি দেখে নেব।

ক. ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
১) অপিনিহির ব্যবহার এই উপভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যেমন – আজি > আইজ, ভাবিয়া > ভাইব্যা ইত্যাদি।

২) বঙ্গালি উপভাষায় সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি সঘোষ অল্পপ্রাণ ধ্বনি রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন – ভাই > বাই, ঘর > গর।
৩) এই উপভাষার আর এক বৈশিষ্ট্য ঘৃষ্টধ্বনির উষ্মধ্বনি রূপে উচ্চারণ। যেমন – খেয়েছে > খাইসে, জানতে > স্‌জান্তি ।
৪) ‘স’ ও ‘শ’ স্থানে ‘হ’ উচ্চারিত হওয়া বঙ্গালি উপভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যেমন – বসো > বহো, সে > হে ইত্যাদি।
৫) শব্দের আদিতে ও মধ্যে ‘হ’ স্থানে ‘অ’ উচ্চারিত হয়। যেমন – হয় > অয়।

খ. রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
১) বঙ্গালি উপভাষায় অধিকরণ কারকের বিভক্তি হয় ‘ত’। যেমন – বাড়িত থাকুম।
২) কর্তৃকারক ছাড়া অন্য কারকের বহুবচনে বিভক্তি হল ‘গো’। যেমন – আমাগো খাইতে দিবা না?
৩) কর্তৃকারকের ক্ষেত্রে এই উপভাষায় ‘এ’ বিভক্তি যুক্ত হয়। যেমন – রামে (রাম + এ) খায়।

৩. বরেন্দ্রী উপভাষা

এরপর আমাদের আলোচ্য উপভাষাটি হল বরেন্দ্রী উপভাষা। এই উপভাষার এলাকাগুলি হল মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা। এই উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি দেখে নেওয়া যাক।

ক. ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১) শব্দের আদিতে যেখানে ‘র’ থাকার কথা নয় সেখানে ‘র’ এর আগম হয়। আবার, যেখানে ‘র’ থাকার কথা সেখানে ‘র’ লোপ পায়। যেমন – আমের রস > রামের অস ।
২) বঙ্গালি উপভাষার প্রভাবে বরেন্দ্রীতে জ (J) প্রায়ই জ্ (Z) রূপে উচ্চারিত হয় ।
৩) রাঢ়ীতে শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাত পড়ে, কিন্তু বরেন্দ্রীতে শ্বাসাঘাত অতখানি সুনির্দিষ্ট স্থানে পড়ে না ।

খ. রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১) এই উপভাষায় অধিকরণ কারকে কখনো কখনো ‘ত’ বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। যেমন – ঘরত (ঘরে)।
২) সামান্য অতীতে উত্তম পুরুষে ‘লাম’ বিভক্তি যুক্ত হয়। যেমন – খেলাম, গেলাম।

৪. ঝাড়খন্ডী উপভাষা

বাংলা ভাষার পাঁচটি উপভাষার মধ্যে ঝাড়খণ্ডী অন্যতম। এই উপভাষার এলাকাগুলি হল মানভূম, সিংভূম, ধলভূম, দক্ষিণ-পশ্চিম বাঁকুড়া, দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুর। এই উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি দেখে নেওয়া যাক।

ক. ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১) ঝাড়খণ্ডী উপভাষায় অনুনাসিক স্বরধ্বনির বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন – চাঁ, আটাঁ, উঁট ইত্যাদি।
২) ‘ও’ কারের জায়গায় ‘অ’ কারের প্রবণতা এই উপভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যেমন – লোক > লক, চোর > চর।
৩) এই উপভাষায় অল্পপ্রাণ ধ্বনিকে মহাপ্রাণ ধ্বনিরূপে উচ্চারণ করা হয়। যেমন – পতাকা > ফতকা, দূর > ধূর।

খ. রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১) ক্রিয়াপদের স্বার্থিক ‘ক’ প্রত্যয়ের ব্যবহার ঝাড়খণ্ডী উপভাষার বিশেষ রূপতাত্ত্বিক একটি বৈশিষ্ট্য। যেমন – যাবেক, খাবেক।
২) এই উপভাষায় নামধাতুর বহুল ব্যবহার দেখা যায়। যেমন – এবার শীতে ভারি জাড়াচ্ছিল।
৩) এই উপভাষায় অধিকরণ কারকে বিভক্তি হল ‘কে’। যেমন – রাইতকে ।
৪) যৌগিক ক্রিয়াপদে ‘আছ’ ধাতুর জায়গায় ‘বট’ ধাতুর ব্যবহার। যেমন – করি বটে, জল বটে।

৫. কামরূপী উপভাষা

বাংলা ভাষার উপভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম হল এই কামরূপী উপভাষা। এই উপভাষার এলাকাগুলি হল জলপাইগুড়ি, রংপুর, কোচবিহার, কাছাড়, শ্রীহট্ট, ত্রিপুরা। এই উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি নীচে আলোচিত হল।

ক. ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১) কামরূপী উপভাষায় সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি শুধু শব্দের আদিতে বজায় আছে, মধ্য ও অন্ত্য অবস্থানে প্রায়ই পরিবর্তিত হয়ে অল্পপ্রাণ হয়ে যায়। যেমন – সমঝা > সমজা।
২) ‘ও’ কখনো কখনো ‘উ’ রূপে উচ্চারিত হতে দেখা যায় । যেমন – তোমার > তুমার। তবে এই প্রবণতা সর্বত্র প্রযুক্ত হয় এমন নয়।
৩) এই উপভাষায় শব্দের মধ্যে ও অন্তেও শ্বাসাঘাত পড়ে।

খ. রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
১) গৌণ কর্মে বিভক্তি হল ‘ক’। যেমন – হামাক (আমাকে)। খ) অধিকরণ কারকের বিভক্তি হল ‘ত’। যেমন – পাছত (পশ্চাতে) ।
২) সম্বন্ধ পদের বিভক্তি হল ‘র’, ‘ক’। যেমন – বাপোক (বাপের)।
৩) কামরূপী উপভাষায় উত্তম পুরুষে একবচনের সর্বনাম হল ‘মুই’, ‘হাম’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

TO GET LATEST UPDATES AND TUTORIALS FOR FREE..

X