চণ্ডীমঙ্গল কাব্য – সঠিক কাহিনি পড়ুন
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ধারায় মঙ্গলকাব্য তথা চণ্ডীমঙ্গল কাব্য একটি অন্যতম অধ্যায়। দেবী চণ্ডীর স্বরূপ প্রকাশ এবং মর্ত্যে দেবীর পুজো প্রচার, সেই সঙ্গে দেবীর মহিমা কীর্তন করাই এই কাব্যের মুখ্য বিষয়। যদিও সাহিত্য হিসেবে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের বিশেষ মূল্য অনস্বীকার্য। আমাদের এই আলোচনায় চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনিটি সহজ সরল ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে ।
সমগ্র চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের দুটি কাহিনি – (১) আখেটিক খণ্ড বা কালকেতু ও ফুল্লরা কাহিনি এবং (২) বণিক খণ্ড বা ধনপতি-খুল্লনা-লহনা কাহিনি। প্রথমে আখেটিক খণ্ডের কাহিনি উপস্থাপিত হল।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্য – আখেটিক খণ্ডের কাহিনি
অসীম শক্তির অধিকারিণী ও বরাভয়দাত্রী দেবী চণ্ডীর প্রধান উদ্দেশ্য হল মর্ত্যে নিজের পুজো প্রচার করা। সংসারে তাঁর সঙ্গে শিবের প্রতিনিয়তই বিরোধ। তাই দেবী তাঁর সখী পদ্মার পরামর্শে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরের মাধ্যমে মর্ত্যে নিজের পুজো প্রচার করবেন এমন সিদ্ধান্ত করলেন।
নীলাম্বর একদিন পিতার শিব পুজোর ফুল তোলার জন্য গেলেন নন্দনকাননে। কিন্তু সেখানে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে যান। তিনি দেখেন সেই কাননে কোনো ফুলই নেই। ফুলের সন্ধান করতে নীলাম্বর মর্ত্যলোকে উপস্থিত হন। এই সময় দেবী চণ্ডী এক ফুলের মধ্যে কীটরূপে আত্মগোপন করে রইলেন; না জেনেই সেই ফুল সংগ্রহ করলেন নীলাম্বর। ইন্দ্রের শিব পুজোর সময় ফুলে কীটরূপিনী চণ্ডী শিবকে দংশন করেন। দংশন জ্বালায় জর্জরিত শিব তখন নীলাম্বরকে অভিশাপ দিলেন – মর্ত্যে ব্যাধসন্তান রূপে জন্মানোর। শিবের অভিশাপে নীলাম্বর মর্ত্যে ব্যাধ ধর্মকেতুর পুত্র কালকেতু রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্বর্গলোকের পত্নী ছায়া মর্ত্যে সঞ্জয় ব্যাধের কন্যা ফুল্লরা রূপে জন্মগ্রহণ করেন।
কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী ও অন্যান্য কবি সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য দেখুন
কালের নিয়মে দিনে দিনে কালকেতু বড়ো হতে থাকে। একসময় অসীম পরাক্রমের অধিকারী হয় সে। বনের পশুরা তার ভয়ে ভীত হয়ে উঠল। বিপন্ন পশুরা দেবী চণ্ডীর কাছে অভয় প্রার্থনা করল। দেবী তাদের অভয় দান করলেন।
একদিন দেবী চণ্ডী সমস্ত পশুদের লুকিয়ে রেখে নিজে স্বর্ণগোধিকার ছদ্মবেশে জঙ্গলে কালকেতুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। দেবীর মায়ায় কালকেতু শিকারে এসে কোনো পশুকে দেখতে পেল না। ক্রুদ্ধ কালকেতু সামনে স্বর্ণগোধিকা দেখতে পেয়ে তাকেই ধনুকের ছিলায় বেঁধে বাড়ি ফিরে এলেন। শিকারের এই অবস্থা দেখে হতাশ হল ফুল্লরা। সে মনের দুঃখে প্রতিবেশির বাড়িতে গেল খুদ ধার করতে। অন্যদিকে কালকেতু মাংস বিক্রি করতে হাটে চলে গেল।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্য – আরো পড়ুন
এদিকে প্রতিবেশির কাছ থেকে ফিরে এসে ফুল্লরা গোধিকাকে দেখল এক অপূর্ব নারী রূপে । ফুল্লরা তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে ছদ্মবেশিনী চণ্ডী বলেন, তাঁর ইচ্ছা তিনি ফুল্লরার সতীন হয়ে এই গৃহেই থাকেন এবং তাদের পরিবারের দুর্গতি বিনাশ করেন। ফুল্লরা ছদ্মবেশিনী দেবী চণ্ডীকে তার স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে বলে এবং তাকে নানাভাবে তিরস্কার করতে থাকে। কিন্তু সেই নারী ফুল্লরার কোনো কথায় সম্মত হয় না। অবশেষে ফুল্লরা বাজারের বেরিয়ে যায় স্বামী কালকেতুর সন্ধানে।
ফুল্লরা স্বামীকে পূর্বাপর সমস্ত কথা জানায়। কালকেতু সব শুনে হতবাক হয়। বাড়ি ফিরে সেও ছদ্মবেশিনী দেবীকে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য বুঝিয়ে বলে। কিন্তু তাতেও কাজ হয় না। তখন ক্রুদ্ধ কালকেতু ধনুকে শর যোজন করেন – দেবী নিজ মূর্তি ধারণ করেন। দেবী চণ্ডী কালকেতুকে সাত ঘড়া ধন ও বহুমূল্য একটি আংটি দেন। কালকেতুকে জঙ্গল কেটে গুজরাট নগর স্থাপন করতে বলেন এবং তাঁর পুজো করার নির্দেশ দেন।
দেবী প্রদত্ত বহুমূল্য আংটি গ্রহণ করে কালকেতু সেই আংটি ভাঙাতে যায় বণিক মুরারি শীলের কাছে। কিন্তু চতুর ও খল মুরারি কালকেতুর সঙ্গে ছলনা করার চেষ্টা করে। কিন্তু দেবীর কৃপায় প্রতারিত হবার মুহুর্তে দৈব্যবাণী হওয়ায় মুরারি শীল কালকেতুকে আংটির উচিত মূল্য ফিরিয়ে দেয়। এরপর কালকেতু দেবীর নির্দেশ মতো জঙ্গল কেটে গুজরাট নগর পত্তন করে। সেই নগরে হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে নানা জাতির বসতি গড়ে ওঠে।
কাহিনির শেষ পর্যায়
নগরের প্রজাসকলের মাঝে ভাঁড়ুদত্ত নামে এক ধূর্ত কায়স্থ সন্তান ছিল। সে কালকেতুর রাজ্যে নানা অত্যাচার শুরু করে। প্রজারা কালকেতুর কাছে নালিশ জানাতে আসে। প্রজাদের অভিযোগ সত্য হওয়ায় কালকেতু ভাঁড়ুকে তার রাজ্য থেকে বিতারিত করে। কিন্তু প্রতিহিংসা পরায়ণ ভাঁড়ু পার্শ্ববর্তী রাজ্য কলিঙ্গে চলে যায়। সেখানে কলিঙ্গরাজকে কালকেতুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে এবং যুদ্ধের ষড়যন্ত্র করে।
ভাঁড়ুদত্তের ষড়যন্ত্রে কলিঙ্গরাজের সঙ্গে যুদ্ধে কালকেতু পরাজিত ও বন্দী হয়। কলিঙ্গের কারাগারে অশেষ দুঃখ পেয়ে অবশেষে কালকেতু দেবী চণ্ডীর স্মরণাপন্ন হয়। দেবীর প্রকোপে কলিঙ্গরাজ্যে প্রচণ্ড বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিল। দেবী কলিঙ্গরাজকে স্বপ্ন দিলেন। কালকেতু যে দেবী চণ্ডীর বরপুত্র তা জেনে কলিঙ্গরাজ তৎক্ষণাৎ কালকেতুকে মুক্তি দিয়ে তার রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন। কালকেতু রাজ্য ফিরে পেয়ে ভাঁড়ুকে যথোচিত শাস্তি দিল।
কালকেতু দেবী চণ্ডীর মহাসমারোহে পুজো করল। দেবীর কৃপায় পরম শান্তিতে দীর্ঘদিন রাজ্য শাসনের পর পুত্রকে রাজ্যভার দিয়ে কালকেতু ও ফুল্লরা নিজ নিজ মহিমায় স্বর্গে ফিরে গেল। মর্ত্যে দেবী চণ্ডীর পুজো প্রচারিত হল।