মনসামঙ্গল কাহিনী – বিস্তারিত পড়ুন
আমরা এর আগে চণ্ডীমঙ্গলের আখেটিক খণ্ড ও বণিক খণ্ডের সম্পূর্ণ কাহিনী উপস্থাপন করেছি। ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনিও পরিবেশিত হয়েছে। আগ্রহীরা তা পড়ে দেখতে পারেন। অনেকের সুবিধার্থে আজ আমরা মনসামঙ্গল কাহিনী নিয়ে উপস্থিত হলাম। মনসামঙ্গল কাব্যের ও কবিদের নানা তথ্য পাবেন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল প্রয়াসে। তথ্যগুলি বিভিন্ন পরীক্ষার উপযোগী।
মনসামঙ্গল কাহিনী – চাঁদ সদাগরের জন্ম
চাঁদ সদাগর একান্তভাবে শিব ভক্ত। একদিন তিনি স্বর্গের অরণ্যে শিব পুজোর জন্য ফুল তুলছিলেন। ক্রমে তিনি অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করেন। সেখানে মনসাদেবী বিভিন্ন নাগের আবরণে সজ্জিতা হয়ে ছিলেন। কিন্তু চাঁদের আগমনে সমস্ত নাগ ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। ফলে মনসা নিরাবরণা হয়ে পড়েন। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চাঁদকে অভিশাপ দিলেন মর্ত্যে মানুষ রূপে জন্ম নেওয়ার। চাঁদ মনসাকে বললেন, বিনা অপরাধে তুমি আমাকে অভিশাপ দিলে, স্মরণে রেখ মর্ত্যে আমি তোমার পুজো না করলে মর্ত্যলোকে তোমার পুজো প্রচারিত হবে না। মনসার অভিশাপের ফলে মর্ত্যে বিজয় সাধুর পুত্ররূপে চাঁদের জন্ম হয়।
চাঁদ সদাগর বনাম দেবী মনসা
চাঁদের স্ত্রী সনকা মনসার ভক্ত এবং তিনি গোপনে মনসার পুজো করেন। একদিন ক্রুদ্ধ চাঁদ মনসার ঘট ভেঙে দিলেন। শিবভক্ত চাঁদ সদাগর মনসার পুজো কোনোভাবেই মেনে নিতে রাজি হন না। প্রতিশোধ নিতে মনসার রোষে চাঁদের চম্পক নগরে সাপের উপদ্রব শুরু হয়। একে একে চাঁদের ছয় সন্তান মারা যায়। বাণিজ্যের নৌকা ডুবে গেলে চাঁদ সব হারিয়ে সর্বশান্ত হন। তবুও মনসার পূজাতে রাজি হন না তিনি ।
অন্যদিকে চাঁদের স্ত্রী সনকা মনসার বরে পুত্রলাভ করেন। কনিষ্ঠ এই পুত্রের নাম লখিন্দর। কিন্তু মনসার শর্ত ছিল, যদি চাঁদ সদাগর মনসার পূজা না দেয় তবে লখিন্দর বাসর ঘরে সাপের কামড়ে মারা যাবে। এসব জেনেও চাঁদ লখিন্দরের সাথে উজানিনগরের সায়বেনের কন্যা বেহুলার বিয়ে ঠিক করেন। চাঁদ সদাগর সতর্কতা হিসেবে বেহুলা-লখিন্দরের বাসর ঘর এমনভাবে তৈরি করেন যা সাপের পক্ষে ছিদ্র করা সম্ভব নয়। কিন্তু সকল সাবধানতা স্বত্ত্বেও মনসার উদ্দেশ্য সাধন আটকানো যায়নি। বাসর রাতে সর্প দংশনে লখিন্দরের মৃত্যু হয়।
বেহুলার স্বর্গযাত্রা
লখিন্দরের জীবন ফিরিয়ে আনতে বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ গাঙুরের জলে ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে যাত্রা করে গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিয়ে তাদের ভেলা এসে পৌঁছায় এক ঘাটে। ঘাটটির নাম নেতা ধোপানির ঘাট। সেই ঘাটে প্রতিদিন স্বর্গের ধোপানি কাপড় ধোয়। বেহুলা সেখানে এক অবাক করা কাণ্ড দেখল।
ধোপানি কাপড় ধুতে এসেছে। সঙ্গে একটি ছোটো শিশু। শিশুটি খুব দুরন্ত ও সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে চলেছে। ধোপানি এক সময় শিশুটিকে একটি আঘাতে মেরে ফেলল। পরে কাপড় কাচা হয়ে গেলে সে শিশুটিকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলে গেলো। বেহুলা বুঝতে পারল, এই ধোপানি মৃত মানুষ বাঁচাতে জানে। পরদিন বেহুলা গিয়ে তার পায়ে পড়ল এবং তার স্বামীকে বাঁচিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করল।
ওই ধোপানির নাম নেতা। সে বলল, “একে আমি বাঁচানো আমার কম্ম নয়, একে মনসা মেরেছে। তুমি স্বর্গে যাও, দেবতাদের সামনে উপস্থিত হও। দেবতাদের তুমি যদি তোমার নাচ দেখিয়ে মুগ্ধ করতে পারো, তাহলে তারা তোমার স্বামীকে বাঁচিয়ে দেবে।”
নৃত্য পরিবেশন এবং
বেহুলার মনে আশার আলো জ্বলে উঠল। সে স্বর্গে গেল। দেবতারা ব’সে আছেন। তাদের সামনে বেহুলার নৃত্য পরিবেশন শুরু হল। তার নাচে চঞ্চল হয়ে উঠল চারদিক। বেহুলার অসাধারণ নৃত্যে মুগ্ধ হল দেবতারা। তারা বেহুলাকে বর প্রার্থনা করতে বলল। বেহুলা তার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা করল। দেবাদিদেব মহাদেব সম্মত হলেন এবং মনসাকে লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।
মনসা জানাল, সে লখিন্দরকে ফিরিয়ে দিতে পারে একটি শর্তে – যদি চাঁদ সদাগর তার পুজো করে। বেহুলা তাতে রাজি হল, এবং বলল, তাহলে তোমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে আমার শ্বশুরের সমস্ত কিছু। ফিরিয়ে দিতে হবে তাঁর মৃত পুত্রদের, তাঁর সমস্ত বাণিজ্যতরী। রাজি হলো মনসা।
মনসার পুজো প্রচার
মনসা সব ফিরিয়ে দিল, বেঁচে উঠলো লখিন্দর, ভেসে উঠল চাঁদের চোদ্দ ডিঙা। চাঁদ পাগলের মতো ছুটে এল বেহুলার কাছে। কিন্তু সে যখন শুনল যে তাকে মনসার পুজো করতে হবে, তখন সে কিছুতেই সম্মত হল না। বেহুলা গিয়ে কেঁদে পড়ল চাঁদের পায়ে। বেহুলা বলল, ‘তুমি শুধু বাঁ হাতে একটি ফুল দাও, তাতেই মনসা খুশি হবে।’ চাঁদ বেহুলার অশ্রুর কাছে হার মানল। চাঁদ বললো, ‘আমি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বাঁ হাতে ফুল দেব।’ তাতেই রাজি মনসা। চাঁদ সদাগর মুখ ফিরিয়ে বাঁ হাতে একটি ফুল যেন অবহেলায় ছুঁড়ে দিল। মনসা এতেই খুশি হল। তারপর থেকে পৃথিবীতে মনসার পুজো প্রচারিত হল।